শীতের প্রাবল্য ক্রমেই বাড়ছে। এই সময়ে নানা অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে । তাই রোগবালাই রোধে আগেভাগে নেওয়া দরকার কিছু প্রস্তুতি। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম আব্দুল্লাহ।
হাঁপানি বা অ্যাজমা
অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীরা শীতে বেশী কষ্ট পায়। যে কোনো বয়সী মানুষের হাঁপানি হলেও বয়স্ক মানুষেরা ভোগেন। বেশি শীতের সময় দিনের মধ্যভাগে ধুলাবালি কল-কারখানা বা যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকে বাতাসে ঝুলন্ত কণায় পরিবেশ দূষণ বেশি হয়।
এ সময়ে অ্যাজমা আক্রান্তদের কিছুটা নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করা উচিত। শীতের পুরো সময় জুড়ে প্রচুর পানি পান করলে শ্বাসনালীতে মিউকাস তৈরি হয়। রোগ জীবাণু বের হয়ে যায়। এছাড়া খুব ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাইরে বের না হওয়া। দুলাবালি পশুর লোম ফুলের রেনুর সংস্পর্শ পরিহার চিকিৎসকের পরামর্শে আগে থেকেই ওষুধ ও ইনহেলারের ঠিক করে নেওয়া উচিত। যদি কোনো কারনে অ্যাজমা পরিস্থিতির হঠাৎ অবনতি হয় তখন যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে অক্সিজেন নেবুলাইজার প্রয়োগসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা দিতে হবে।
ঠান্ডা সর্দি-কাশি
শীতের কমন রোগ সর্দি কাশি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা খুব কম মানুষই আছে যাদের শীতকালে এ রোগ হয়নি। ভাইরাসজনিত কারণে এই রোগ হতে পারে। ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ ছাড়াও এতে সর্দিকাশির সঙ্গে থাকতে পারে। আবার শ্বাসকষ্ট হতে পারে শীতের শুরুতে। তাপমাত্রা কমার সময়ে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। বর্তমান সময়টা ঠিক সেরকমই একটি সময় এ রোগের শুরুতে গলা ব্যথা করে গলায় খুসখুসে ভাব ও শুকনা কাশি দেখা দেয়। নাক বন্ধ হয়ে যায় নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে।
সর্দি-কাশি ঠেকাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে কোন ভাবেই ঠান্ডা লাগানো যাবেনা । শীতের প্রস্তুতি নিয়ে সেভাবেই জামা কাপড় পরিধান করতে হবে। ধুলাবালি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিছন্নতা বা পার্সোনাল হাইজিন এর দিকটিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সর্দি কাশি ও অন্যজনের মাধ্যমে ছড়ায় বলে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকতে হবে । কারো অসুখ হয়ে গেলে ভালো না হওয়া পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের না হওয়াই শ্রেয়। বিশেষ করে স্কুল শিক্ষার্থীদের বাইরে গেলেও মুখে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো।
টনসিলাইটিস
গলাব্যথা স্বরভঙ্গ কণ্ঠনালির নানা সমস্যা সহ টনসিলের প্রদাহ বা টনসিলাইটিস বেশি হয়। শীতে সাধারণত বাইরের জনিত কারণে এই রোগ বেশি হয় । এক্ষেত্রে ওষুধ সেবনের খুব একটা দরকার পড়ে না।
এসব সমস্যা যাদের রয়েছে তারা লবন মেশানো হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে আরাম পাবেন। ঠান্ডা পানি পরিহার করে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন এবং গলায় গরম কাপড় বা মাফলার জড়িয়ে রাখুন। সেই সঙ্গে মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করলে ভালো থাকা যায়। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ও সর্দি কাশি থাকলে এন্টিহিস্টামিন সেবন করা উচিত।
বাত ব্যথা
আর্থাইটিস বা বাতের সমস্যা শীতে বেশি বাড়ে । মূলত বয়স্ক দের এ সমস্যা হয় । বিশেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস স্পন্ডাইলো আর্থাইটিস, রি অ্যাকটিভ আর্থাইটিস সোরিয়াসিটিস অস্টিও আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের সময় চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়।
এ জন্য করণীয় হলো যথাসম্ভব গরম উত্তাপে থাকা, হালকা গরম সেঁক দেওয়া, মোজা পরিধান করা, ওজন কমানো, একটানা অনেকক্ষণ বসে না থেকে যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা বা হাঁটাহাঁটি করা। প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার করা ফিজিওথেরাপি নেওয়া ও চিকিৎসকের পরামর্শে চলা।
হৃদরোগ
তীব্র শীতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বেড়ে গেলে হৃদ যন্ত্রের উপর বাড়তি চাপ পড়ে এতে হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে ভোরের দিকে যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ঝুঁকি একটু বেশী। এজন্য শীতের অন্যান্য সাধারণ নিয়ম মেনে চলা ও সতর্ক থাকা উচিত । সবার ঘরের পরিবেশ যথাসম্ভব উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা করা। শীতে কুয়াশার মধ্যে নয় বরং একটু রোদ উঠলেই বাইরে বের হয়ে হাটাহাটি বা ব্যায়াম করা ভালো। সালাত সিজনাল ফলমূল বেশি খাওয়া উচিত । কারো হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে মনে হলে জিভের নিচে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে করা অথবা দ্রুত হূদরোগ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে।
হাইপোথার্মিয়া
শীতের মাত্রা অতি তীব্র হয়ে গেলে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে অর্থাৎ যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হারে কমে যেতে শুরু করে ঠিক তখনই হাইপোথার্মিয়া দেখা দেয়। শিশু বয়স্ক ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। কারণ তাদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা কম হাইপোথার্মিয়া হলে শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে। শরীরের তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায় এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে।
হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধ করা যায়। এজন্য পর্যন্ত গরম কাপড় সহ হাত মোজা, পা মোজা, পরিয়ে রাখতে হবে। সবক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। গরম পানি পান ও গরম খাবার খেতে হবে, রুম গরম রাখতে আগের থেকে রুম হিটারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে ত্বক যেন একেবারে শুষ্ক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ রোগের যে কোনো লক্ষণ যেমন শরীরের কাপুনি অসাড়তা আরষ্টতা ইত্যাদি দেখা মাত্র জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
এসব রোগ ছাড়াও নানা রোগ হতে পারে শীতকালে যাতে সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।
সহায়ক খাবারদাবার
শীতে খাবার দাবারের রয়েছে বেশ ভূমিকা। কিছু খাবার শীত সহায়ক
ভিতামিন সি' শীতে কাবু হতে নয় বরং শীত কে কাবু করে দিতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের জুড়ি নেই। এসময় খেতে পারেন লেবু, কমলা, স্ট্রবেরী, বেদনা, মালটা, আঙ্গুর বা সাইট্রাস জাতীয় ফল। এসব খাবারে প্রচুর ভিটামিন 'সি' অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
উজ্জ্বল রঙের খাবার: উজ্জ্বল রংয়ের খাবার-দাবার শীতের জন্য বেশ সহায়ক । এর জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন শাকসবজি ও মৌসুমী ফলমূল। খেতে পারেন ব্রকলি পালং শাক, বাদামি অর্গানিক চাল নানা ধরনের ডাল শিম ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার।
ভিটামিন ডি: ডায়েট চার্টে রাখুন ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার, জিংক ঘরে বানানো ভেষজ পানীয় ইত্যাদি। ঘরে না থেকে শীতের সকালের রোদ লাগান এটি ভিটামিন। এটি ভিটামিন ডি'র সবচেয়ে ভালো উৎস তবে বেশি বেলার তীর্যক রোদ নয়।
মধু: মধুতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম,কপার,সালফার, পটাশিয়াম সহ সব ধরনের ভিটামিন এবং উচ্চমাত্রার খনিজ লবণ। এতে থাকা প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধের বেশ কার্যকর যাদের ঠান্ডা লাগার সমস্যা আছে তারা প্রতিদিন সকালে গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে বা রাতে শোবার আগে খেতে পারেন মধু।
দুধ/দই: শীতে খাঁটি দূত হতে পারে আদর্শ খাবার। দুধের প্রোটিন ভিটামিন এ, বি১২ ও ক্যালসিয়াম শীত সংক্রান্ত ব্যাথা-বেদনা উপশম করে। এছাড়া নানা রোগের হাত থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ রক্ষা করার ক্ষমতা রাখে । দই প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর ১০০ গ্রাম দই খেতে পারলে ভালো।
আদা চা: জ্বর সর্দি কাশির হাত থেকে বাঁচতে বা ঠান্ডা লাগার সমস্যা রয়েছে যাদের তারা প্রতিদিন আধা চা পান করতে পারেন।
তুলসী পাতা: জ্বর সর্দি-কাশি গলাব্যথা রোধে তুলসী পাতার জুড়ি নেই। এতে থাকা বিটা ক্যারোটিন এন্টিঅক্সিডেন্ট এর কাজ করে আব ইউজিলন ব্যাকটেরিয়া রোধ করে। তাছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাস বা রেসপিরেটরি সিস্টেম এর জন্য খুব উপকারী। চা এর সঙ্গেও কয়েকটি তুলসী পাতা কিংবা তুলসী চা পান করা যেতে পারে।